নবী আদম (আ.)। ভূ-পৃষ্ঠে প্রথম মানবের পাশাপাশি পৃথিবীতে আল্লাহর প্রেরিত প্রথম নবী তথা মুক্তির দিশারী। তিনি প্রথম মানুষ হওয়ার কারণে তাকে বলা হয়ে থাকে আদি পিতা বা মানব জাতির পিতা। তখন পৃথিবীতে আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালামই একমাত্র দম্পতি। আল্লাহ তাদের মাধ্যমে মানবজাতকে বংশানুক্রমে বৃদ্ধির ইচ্ছা করলেন। নির্দেশ করেন আদম ও হাওয়া (আ.) এর ঔরসজাত সন্তানদের পরস্পর বিয়ের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধিকরণের। আল্লাহ হাওয়া (আ.) এর প্রতি গর্ভে একজন ছেলে ও একজন মেয়ে যমজ দুই সন্তান দান করতেন। একই গর্ভে জন্ম নেওয়া যমজ ছেলেমেয়ে ভাইবোন হিসেবে বিবেচিত হত। এজন্য তাদের মধ্যকার একে অন্যে বিয়ে ছিলো নিষিদ্ধ। বরং পরবর্তী গর্ভের ছেলে বা মেয়ের সাথে বিয়ে হবে। পর্যায়ক্রমে হাওয়া (আ.) এর একই গর্ভে কাবিল ও আকলিমা এবং অন্য গর্ভে হাবিল ও লিওয়াজা জন্মগ্রহণ করেন।1 নিয়মমতো কাবিল লিওয়াজাকে এবং হাবিল আকলিমাকে বিয়ে করবেন। এখানে বেকে বসেন কাবিল। চাইলেন লিওয়াজা নয় বরং তারই সাথে একই গর্ভে জন্ম নেওয়া যমজ বোন আকলিমাকে বিয়ে করতে। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে ঘটনা আদম (আ.) এর কাছে যায়। কাবিল জেদ ধরায় আদম (আ.) বললেন, উভয়ে কুরবানী দিতে। যার কুরবানী আল্লাহর দরবারে কবূল হবে সেই লিওয়াজাকে বিয়ে করবে। ‘এক্ষেত্রে কবুলের আলামত হলো, আকাশ থেকে অগ্নিশিখা কুরাবানীর পশু বা পণ্য জ্বালিয়ে দিবে।’2 যার কুরবানী জ্বলবে না, তার কুরবানী মকবূল নয়। শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের আগ পর্যন্ত কুরবানীর এইরূপ বিধান ছিল। হাবিল পশু পালনের কারণে তিনি দুম্বা আর কাবিল কৃষি কাজ করার দরুন কিছু শস্য কুরবানী হিসেবে পেশ করলেন। হাবিলের দেওয়া কুরবানীর পশু দুম্বা আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত অগ্নিশিখা এসে জ্বালিয়ে দিল বিপরীতে কাবিলের শস্য রইলো অপরিবর্তিত। কুরবানী কবূলের ফলাফল সেই হাবিলের পক্ষেই থাকলো। এখানেও কাবিল এই ফয়সালা মেনে নিলেন না। অগ্রাহ্য করে হাবিলকে আক্রমণ করেন। হাবিল এই লড়াইয়ে রাজি ছিলেন না। কিন্তু কাবিলের জবরদস্তিমূলক আঘাতে মারা যান হাবিল। আল্লাহ কুরআন কারীমে সূরা মায়িদার ২৭-৩১ আয়াতে তাদের এই ঘটনা বয়ান করেন।3
এভাবে কুরবানী শুরু হয় মানবজাতির প্রথম যুগ থেকেই। কুরবানী আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ত্যাগের নমুনা। এই ধারাবাহিকতা চললো সকল যুগে। প্রতিটি জাতির জন্যই আল্লাহ কুরবানীর রুসম দিয়েছিলেন,
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ
-আমি (আল্লাহ) প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর বিশেষ রীতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেনো তারা এসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যেগুলো আল্লাহ রিযিকরূপে প্রদান করেছেন। (সূরা হজ্জ, আয়াত-৩৪)
আজকের কুরবানীর শুরুটা সেই হাবিল-কাবিলের দেওয়া কুরবানীর আসল থেকে। শুরুটা তাদের থেকে হলেও উম্মতে মুহাম্মদীর কুরবানীর ইবাদত কিন্তু ইবরাহীম (আ.) এর প্রিয় সন্তান ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানী দেওয়া কেন্দ্রিক পরীক্ষার অনুসরণে। সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে কুরবানী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন,
يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا هَذِهِ الْأَضَاحِيُّ ؟ قَالَ : سُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ
-হে আল্লাহর রাসূল! এই কুরবানী কী? তিনি বললেন, এটা তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহীমের সুন্নাত।4
নবী ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আনয়নকারীর নাম মুসলিম রেখেছিলেন। এজন্য তিনি মুসলিম মিল্লাত তথা মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে কুরআনে অভিহিত।5 মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আ.) দীর্ঘদিন কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে চাওয়ার একপর্যায়ে ইসমাঈল (আ.)কে সন্তান হিসেবে পান। তখন বয়স ছিয়াশী।6 মা হাজেরা (আ.)সহ সকলেই পরমানন্দে ঈসমাইল (আ.)কে লালনপালন করতে লাগলেন। ইসমাইল বড় হতে লাগলেন। যখন বাবার সাথে চলাফেরা ও সাহায্য করার মত বয়সে7 উপনীত তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী ইবরাহীমের জন্য বিরাট পরীক্ষার ইশারা আসলো,
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَىٰ فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَىٰۚ قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُۖ سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ وَنَادَيْنَاهُ أَن يَا إِبْرَاهِيمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَاۚ إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ
-অতঃপর তিনি (ইসমাঈল আ.) যখন তাঁর পিতার সাথে চলাফেরার বয়সে উপনীত হলেন, তখন ইবরাহীম তদীয় সন্তানকে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবেহ করছি। এ বিষয়ে তোমার তীক্ষ্ণদর্শনী অভিমত কী? উত্তরে পুত্র বললেন, পিতা আমার, যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করে ফেলুন। আল্লাহ চান তো আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। অতঃপর পিতা ও পুত্র উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করলেন আর পিতা পুত্রকে যবেহ করার জন্য শায়িত করলেন, আমি তখন তাঁকে ডেকে বললাম হে ইবরাহীম তুমিতো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আর এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু। (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২-১০৭)
ঘটনার শুরু হল, ইসমাঈল (আ.) হঠাৎ করে স্বপ্ন দেখতে লাগলেন ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানীর নির্দেশ আসছে৷ পরপর তিনবার স্বপ্ন দেখলেন। ইমাম কুরতুবী (র.) তাফসীরে দিনগুলির বর্ণনা করেন, ইবরাহীম (আ.) তিনবার এ স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রথমবার যিলহজ্জ মাসের আট তারিখে দেখলেন যে, কেউ একজন তাকে তাঁর সন্তানকে কুরবানী করার আদেশ করছেন। তিনি সকালে স্বপ্নের ব্যাপারে চিন্তা করলেন যে, এটা কি আল্লাহর পক্ষ থেকে না শয়তানের পক্ষ থেকে। সেজন্য এ দিনের নাম ‘ইয়াওমুত তারউইয়্যাহ।’ কেননা, তারউইয়্যাতুন অর্থ: চিন্তা-ভাবনা বা ধ্যান করা। দ্বিতীয় রাতে তথা নয় তারিখে আবার অনুরূপ স্বপ্ন দেখলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, এটা আল্লাহরই আদেশ। তাই এ দিনকে ‘ইয়াওমু আরাফা’ বলা হয়। কেননা, আরাফা অর্থ: বুঝা, চিনা, পরিচয় পাওয়া। সর্বশেষ দশ তারিখে তিনি কুরবানী করতে উদ্ধত হলেন। আর এ কারণেই এ দিনকে ‘ইয়াওমুন নাহর’ বলা হয়। কেননা, নাহার অর্থ: কুরবানী, যবেহ, রক্ত প্রবাহিত করা ইত্যাদি।8
কারণ নবীদের স্বপ্ন সত্যি হয়। ইবরাহীম (আ.) স্বপ্ন দেখে মনস্থির করলেন নিজের পরম আদরের সন্তানকে কুরবানী করার। রাসূল (সাঃ) বলেন,
إِنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِياءِ تَنامُ أَعْيُنِنَا وَلَا تَنامُ قُلُوبُنا
-আমরা নবী শ্রেণি, আমাদের চক্ষু ঘুমায় কিন্তু অন্তর ঘুমায় না।9
স্বপ্নগুলো আল্লাহর নির্দেশনা নিশ্চিত হয়ে ইবরাহীম (আ.) সন্তান ইসমাঈল (আ.) এর সাথে পরামর্শ করলেন। পরামর্শ না, বরং অনুভূতি জানতে চাওয়া। তিনি অনুভুতি জানতে চেয়েছেন, কারণ আন্দাজ করতে পেরছেন, ইসমাইল (আ.) সাধারণ সন্তান নয়, বরং আল্লাহর প্রিয়ভাজন। যার চালচলন ছোটবেলা থেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই। ইসমাঈল (আ.) হৃদয়গ্রাহী জবাব দিলেন,
قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُۖ سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ
-(উত্তরে পুত্র) বললেন, পিতা আমার, যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করে ফেলুন। আল্লাহ চান তো আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০৪-১০৫)
ইসমাইল (আ.) এর জবাবে ছিলো আনুগত্য। ছিলো খোদার দরবারে নিজেকে তুচ্ছ করে অবনত মস্তকে ধাবিত করার বিনীত বাক্যের সজ্জিত। তিনি বলেন নাই, নিজে ধৈর্যশীল; বরং এই কথাটাই বললেন, তবে নিজেকে ধৈর্য্যশীলের কাতারে নিয়ে। সেখানে ইনশাআল্লাহ তথা যদি আল্লাহ চান তো আমাকে পাবেন বলে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে করলেন শর্ত। পিতাপুত্রের আলাপচারিতা শেষে সন্তুষ্টচিত্তে চললেন মীনার দিকে। শয়তান অনেক চেষ্টা করেও তাদেরকে ধোঁকায় ফেলতে পারেনি। সে মীনার জামরায় তিন জায়গাতে ইবরাহীম (আ.) কে কুরবানী না করতে প্ররোচনা দিয়েছিলো। কিন্তু তিনি প্রত্যেক বারেই শয়তানকে সাতটি করে পাথর ছুড়ে নিবৃত করতে সক্ষম হন।10
শয়তানের প্ররোচনা, পিতাপুত্রের মায়ার বন্ধনসহ যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে ইবরাহীম (আ.) স্বীয় পুত্রকে মাটিতে শুইয়ে দিবেন, ঠিক তখন পুত্র বললেন, বাবা, দয়া করে আমাকে শক্ত করে বেঁধে নিন, যেনো আমি নড়াচড়া না করি, যেনো রক্ত আপনার গায়ে না পড়ে এতে করে আমার মা বেশি ব্যথাতুর হয়ে যাবেন। সহজেই যাতে আমার প্রাণ বের হয় সেজন্য ছুরিটি ধারালো করে নিন। কেননা, মৃত্যু অনেক কঠিন। আমার সালাম মাকে পৌঁছে দিবেন আর চাইলে আমার জামা আমার মাকে দিতে পারেন।11
এমন পরামর্শমূলক কথোপকথন শুনে বুঝা দায় যে পিতা পুত্রের কুরবানীর প্রস্তুতি নিচ্ছেন আর ছেলে নিজেকে তরবারী তলে সঁপে দিচ্ছেন। মনে হয় এ যেন খোশগল্প। ইবরাহীম (আ.) যাতে করে যবেহের সময় সন্তানের চেহারা দেখা না যায়, তাই ইসমাঈল (আ.) কে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন।12 যবেহ করতে চেষ্টা করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত হয়ে জিবরাঈল (আ.) আসতে আসতে বলে উঠলেন, ‘আল্লাহু আকবার’। ইসমাঈল (আ.) শুনে বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’। ইবরাহীম (আ.) তখন বললেন, ‘আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ’। আল্লাহর এই বড়ত্ব ঘোষণার এই দুআ আল্লাহর দরবারে এমন পছন্দ হল, পরবর্তীতে হজ্জ ও অন্য বিশেষ সময়ে এটা পাঠ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ওয়াজিব হিসেবে বিধান হয়ে গেল।13 তাকবীর পাঠ করে ইবরাহীম (আ.) যতোই চেষ্টা করেন ইসমাঈল (আ.) এর গলা কাটতে কিন্তু সক্ষম হন না। সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে থাকেন। আল্লাহ ইবরাহীম (আ.) এর এ কর্মকাণ্ড পছন্দ করেন। ইসমাঈল (আ.)কে যবেহ ব্যতিরেকেই এই কুরবানী কবূল করে নিলেন। আল্লাহ জান্নাতের দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন ইসমাঈল (আ.) এর জায়গায়। ইবরাহীম (আ.) দেখেন তার পুত্র নয় বরং একটি উন্নত দুম্বা জবাই হয়ে গেছে। হযরত আদম (আ.) এর পুত্র হাবিল যে দুম্বা কুরবানী করেছিলেন সেই দুম্বাই ইসমাঈল (আ.) এর স্থলে আল্লাহ পাঠিয়ে দেন।14 আল্লাহ পাকের দরবারে এ কুরবানী এতোই মাকবূল হয়েছিলো যে, এ কুরবানীর বিধান পরবর্তী সকল উম্মতের মধ্যে কিয়ামত পর্যন্ত প্রচলন করে দিলেন। আল্লাহ বলেন,
وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ
-আর আমি পরবর্তী উম্মতের মধ্যে ইবরাহীমের এ সুন্নাতকে স্মরণীয় করে রাখলাম। (সূরা সাফফাত, আয়াত-১০২)
আল্লাহ ইবরাহীম (আ.)কে অগ্নিকুণ্ডে পতিত হওয়াসহ অসংখ্য কঠিন ও কষ্টকর পরীক্ষায় ফেলেছিলেন। সবগুলোই ধৈর্য ও আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থাবলে উত্তীর্ণ হন। ইবরাহীম (আ.) এর জীবনে সর্বাধিক কঠিন এক পরীক্ষা ছিলো বৃদ্ধ বয়সে লাভ করা নিজের পুত্র ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানী করা। সেক্ষেত্রেও তিনি সফল হয়েছিলেন। বরং আল্লাহ এই ত্যাগের মোহনায় সকল জাতিকে আচ্ছাদিত করে দিলেন। পরবর্তী সবাইকে ইবরাহীম (আ.)কে স্মরণের নেযাম করে দিলেন। এমনকি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকেও কুরবানীর বিধানে আবদ্ধ করলেন। আল্লাহ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে বলেন,
فَصَلَّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
-আপনার রবের জন্য নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন। (সূরা কাউসার, আয়াত-২)
আরো ইরশাদ করলেন,
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
-বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছুই জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। (সূরা আনআম, আয়াত-১৬২)
এজন্য নবীজি eও কুরবানী দিতেন। সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিতেন কুরবানী করার। উম্মতের জন্যেও কুরবানীর বিধান রেখে দিয়েছেন।
ইবরাহীম (আ.) যেভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর সর্বাধিক প্রিয় বস্তু তথা তাঁর আপন পুত্রকে কুরবানী দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তেমনি মুসলমানরা ঈদুল আদহার দিনে নিজের পছন্দের পশু কুরবানীর মাধ্যমে নিজেদের জান-মাল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার নমুনা প্রকাশ করে থাকেন। এ কুরবানী একটি উদাহরণ। মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তার পছন্দসই সুন্দর পশু ক্রয় করে। অথচ এটিকেই আল্লাহর নামে জবাই করে দেয় কুরবানী হিসবে। নিজে কিছুটা ভক্ষণ করে। বাকিটুকু মানুষকে ভাগ করে দেয়। এই ত্যাগই কুরবানীর শিক্ষা। বান্দা যেকোন কিছু বিসর্জন দিতে পারে তার রবের আনুগত্য করতে। হোক তা তার প্রিয় বস্তু, প্রিয়জন কিংবা নিজের আপন জীবন। হতে পারে রবের সন্তুষ্টির জন্য নিজের জিনিস অন্যকে দান করে কিংবা কোনো কামনার বস্তুর লোভকে সংযত করার মাধ্যমে। মহীয়ান রবের সন্তুষ্টিলাভের জন্যে ত্যাগই হল কুরবানীর ইতিহাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মুসলমানরা এই ত্যাগই যুগে যুগে করে এসেছেন কুরবানীর প্রচলিত সুরতে।নবী আদম (আ.)। ভূ-পৃষ্ঠে প্রথম মানবের পাশাপাশি পৃথিবীতে আল্লাহর প্রেরিত প্রথম নবী তথা মুক্তির দিশারী। তিনি প্রথম মানুষ হওয়ার কারণে তাকে বলা হয়ে থাকে আদি পিতা বা মানব জাতির পিতা। তখন পৃথিবীতে আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালামই একমাত্র দম্পতি। আল্লাহ তাদের মাধ্যমে মানবজাতকে বংশানুক্রমে বৃদ্ধির ইচ্ছা করলেন। নির্দেশ করেন আদম ও হাওয়া (আ.) এর ঔরসজাত সন্তানদের পরস্পর বিয়ের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধিকরণের। আল্লাহ হাওয়া (আ.) এর প্রতি গর্ভে একজন ছেলে ও একজন মেয়ে যমজ দুই সন্তান দান করতেন। একই গর্ভে জন্ম নেওয়া যমজ ছেলেমেয়ে ভাইবোন হিসেবে বিবেচিত হত। এজন্য তাদের মধ্যকার একে অন্যে বিয়ে ছিলো নিষিদ্ধ। বরং পরবর্তী গর্ভের ছেলে বা মেয়ের সাথে বিয়ে হবে। পর্যায়ক্রমে হাওয়া (আ.) এর একই গর্ভে কাবিল ও আকলিমা এবং অন্য গর্ভে হাবিল ও লিওয়াজা জন্মগ্রহণ করেন।1 নিয়মমতো কাবিল লিওয়াজাকে এবং হাবিল আকলিমাকে বিয়ে করবেন। এখানে বেকে বসেন কাবিল। চাইলেন লিওয়াজা নয় বরং তারই সাথে একই গর্ভে জন্ম নেওয়া যমজ বোন আকলিমাকে বিয়ে করতে। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে ঘটনা আদম (আ.) এর কাছে যায়। কাবিল জেদ ধরায় আদম (আ.) বললেন, উভয়ে কুরবানী দিতে। যার কুরবানী আল্লাহর দরবারে কবূল হবে সেই লিওয়াজাকে বিয়ে করবে। ‘এক্ষেত্রে কবুলের আলামত হলো, আকাশ থেকে অগ্নিশিখা কুরাবানীর পশু বা পণ্য জ্বালিয়ে দিবে।’2 যার কুরবানী জ্বলবে না, তার কুরবানী মকবূল নয়। শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের আগ পর্যন্ত কুরবানীর এইরূপ বিধান ছিল। হাবিল পশু পালনের কারণে তিনি দুম্বা আর কাবিল কৃষি কাজ করার দরুন কিছু শস্য কুরবানী হিসেবে পেশ করলেন। হাবিলের দেওয়া কুরবানীর পশু দুম্বা আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত অগ্নিশিখা এসে জ্বালিয়ে দিল বিপরীতে কাবিলের শস্য রইলো অপরিবর্তিত। কুরবানী কবূলের ফলাফল সেই হাবিলের পক্ষেই থাকলো। এখানেও কাবিল এই ফয়সালা মেনে নিলেন না। অগ্রাহ্য করে হাবিলকে আক্রমণ করেন। হাবিল এই লড়াইয়ে রাজি ছিলেন না। কিন্তু কাবিলের জবরদস্তিমূলক আঘাতে মারা যান হাবিল। আল্লাহ কুরআন কারীমে সূরা মায়িদার ২৭-৩১ আয়াতে তাদের এই ঘটনা বয়ান করেন।3
এভাবে কুরবানী শুরু হয় মানবজাতির প্রথম যুগ থেকেই। কুরবানী আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ত্যাগের নমুনা। এই ধারাবাহিকতা চললো সকল যুগে। প্রতিটি জাতির জন্যই আল্লাহ কুরবানীর রুসম দিয়েছিলেন,
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ
-আমি (আল্লাহ) প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর বিশেষ রীতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেনো তারা এসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যেগুলো আল্লাহ রিযিকরূপে প্রদান করেছেন। (সূরা হজ্জ, আয়াত-৩৪)
আজকের কুরবানীর শুরুটা সেই হাবিল-কাবিলের দেওয়া কুরবানীর আসল থেকে। শুরুটা তাদের থেকে হলেও উম্মতে মুহাম্মদীর কুরবানীর ইবাদত কিন্তু ইবরাহীম (আ.) এর প্রিয় সন্তান ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানী দেওয়া কেন্দ্রিক পরীক্ষার অনুসরণে। সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে কুরবানী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন,
يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا هَذِهِ الْأَضَاحِيُّ ؟ قَالَ : سُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ
-হে আল্লাহর রাসূল! এই কুরবানী কী? তিনি বললেন, এটা তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহীমের সুন্নাত।4
নবী ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আনয়নকারীর নাম মুসলিম রেখেছিলেন। এজন্য তিনি মুসলিম মিল্লাত তথা মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে কুরআনে অভিহিত।5 মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আ.) দীর্ঘদিন কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে চাওয়ার একপর্যায়ে ইসমাঈল (আ.)কে সন্তান হিসেবে পান। তখন বয়স ছিয়াশী।6 মা হাজেরা (আ.)সহ সকলেই পরমানন্দে ঈসমাইল (আ.)কে লালনপালন করতে লাগলেন। ইসমাইল বড় হতে লাগলেন। যখন বাবার সাথে চলাফেরা ও সাহায্য করার মত বয়সে7 উপনীত তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী ইবরাহীমের জন্য বিরাট পরীক্ষার ইশারা আসলো,
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَىٰ فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَىٰۚ قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُۖ سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ وَنَادَيْنَاهُ أَن يَا إِبْرَاهِيمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَاۚ إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ
-অতঃপর তিনি (ইসমাঈল আ.) যখন তাঁর পিতার সাথে চলাফেরার বয়সে উপনীত হলেন, তখন ইবরাহীম তদীয় সন্তানকে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবেহ করছি। এ বিষয়ে তোমার তীক্ষ্ণদর্শনী অভিমত কী? উত্তরে পুত্র বললেন, পিতা আমার, যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করে ফেলুন। আল্লাহ চান তো আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। অতঃপর পিতা ও পুত্র উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করলেন আর পিতা পুত্রকে যবেহ করার জন্য শায়িত করলেন, আমি তখন তাঁকে ডেকে বললাম হে ইবরাহীম তুমিতো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আর এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু। (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২-১০৭)
ঘটনার শুরু হল, ইসমাঈল (আ.) হঠাৎ করে স্বপ্ন দেখতে লাগলেন ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানীর নির্দেশ আসছে৷ পরপর তিনবার স্বপ্ন দেখলেন। ইমাম কুরতুবী (র.) তাফসীরে দিনগুলির বর্ণনা করেন, ইবরাহীম (আ.) তিনবার এ স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রথমবার যিলহজ্জ মাসের আট তারিখে দেখলেন যে, কেউ একজন তাকে তাঁর সন্তানকে কুরবানী করার আদেশ করছেন। তিনি সকালে স্বপ্নের ব্যাপারে চিন্তা করলেন যে, এটা কি আল্লাহর পক্ষ থেকে না শয়তানের পক্ষ থেকে। সেজন্য এ দিনের নাম ‘ইয়াওমুত তারউইয়্যাহ।’ কেননা, তারউইয়্যাতুন অর্থ: চিন্তা-ভাবনা বা ধ্যান করা। দ্বিতীয় রাতে তথা নয় তারিখে আবার অনুরূপ স্বপ্ন দেখলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, এটা আল্লাহরই আদেশ। তাই এ দিনকে ‘ইয়াওমু আরাফা’ বলা হয়। কেননা, আরাফা অর্থ: বুঝা, চিনা, পরিচয় পাওয়া। সর্বশেষ দশ তারিখে তিনি কুরবানী করতে উদ্ধত হলেন। আর এ কারণেই এ দিনকে ‘ইয়াওমুন নাহর’ বলা হয়। কেননা, নাহার অর্থ: কুরবানী, যবেহ, রক্ত প্রবাহিত করা ইত্যাদি।8
কারণ নবীদের স্বপ্ন সত্যি হয়। ইবরাহীম (আ.) স্বপ্ন দেখে মনস্থির করলেন নিজের পরম আদরের সন্তানকে কুরবানী করার। রাসূল (সাঃ) বলেন,
إِنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِياءِ تَنامُ أَعْيُنِنَا وَلَا تَنامُ قُلُوبُنا
-আমরা নবী শ্রেণি, আমাদের চক্ষু ঘুমায় কিন্তু অন্তর ঘুমায় না।9
স্বপ্নগুলো আল্লাহর নির্দেশনা নিশ্চিত হয়ে ইবরাহীম (আ.) সন্তান ইসমাঈল (আ.) এর সাথে পরামর্শ করলেন। পরামর্শ না, বরং অনুভূতি জানতে চাওয়া। তিনি অনুভুতি জানতে চেয়েছেন, কারণ আন্দাজ করতে পেরছেন, ইসমাইল (আ.) সাধারণ সন্তান নয়, বরং আল্লাহর প্রিয়ভাজন। যার চালচলন ছোটবেলা থেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই। ইসমাঈল (আ.) হৃদয়গ্রাহী জবাব দিলেন,
قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُۖ سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ
-(উত্তরে পুত্র) বললেন, পিতা আমার, যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করে ফেলুন। আল্লাহ চান তো আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০৪-১০৫)
ইসমাইল (আ.) এর জবাবে ছিলো আনুগত্য। ছিলো খোদার দরবারে নিজেকে তুচ্ছ করে অবনত মস্তকে ধাবিত করার বিনীত বাক্যের সজ্জিত। তিনি বলেন নাই, নিজে ধৈর্যশীল; বরং এই কথাটাই বললেন, তবে নিজেকে ধৈর্য্যশীলের কাতারে নিয়ে। সেখানে ইনশাআল্লাহ তথা যদি আল্লাহ চান তো আমাকে পাবেন বলে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে করলেন শর্ত। পিতাপুত্রের আলাপচারিতা শেষে সন্তুষ্টচিত্তে চললেন মীনার দিকে। শয়তান অনেক চেষ্টা করেও তাদেরকে ধোঁকায় ফেলতে পারেনি। সে মীনার জামরায় তিন জায়গাতে ইবরাহীম (আ.) কে কুরবানী না করতে প্ররোচনা দিয়েছিলো। কিন্তু তিনি প্রত্যেক বারেই শয়তানকে সাতটি করে পাথর ছুড়ে নিবৃত করতে সক্ষম হন।10
শয়তানের প্ররোচনা, পিতাপুত্রের মায়ার বন্ধনসহ যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে ইবরাহীম (আ.) স্বীয় পুত্রকে মাটিতে শুইয়ে দিবেন, ঠিক তখন পুত্র বললেন, বাবা, দয়া করে আমাকে শক্ত করে বেঁধে নিন, যেনো আমি নড়াচড়া না করি, যেনো রক্ত আপনার গায়ে না পড়ে এতে করে আমার মা বেশি ব্যথাতুর হয়ে যাবেন। সহজেই যাতে আমার প্রাণ বের হয় সেজন্য ছুরিটি ধারালো করে নিন। কেননা, মৃত্যু অনেক কঠিন। আমার সালাম মাকে পৌঁছে দিবেন আর চাইলে আমার জামা আমার মাকে দিতে পারেন।11
এমন পরামর্শমূলক কথোপকথন শুনে বুঝা দায় যে পিতা পুত্রের কুরবানীর প্রস্তুতি নিচ্ছেন আর ছেলে নিজেকে তরবারী তলে সঁপে দিচ্ছেন। মনে হয় এ যেন খোশগল্প। ইবরাহীম (আ.) যাতে করে যবেহের সময় সন্তানের চেহারা দেখা না যায়, তাই ইসমাঈল (আ.) কে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন।12 যবেহ করতে চেষ্টা করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত হয়ে জিবরাঈল (আ.) আসতে আসতে বলে উঠলেন, ‘আল্লাহু আকবার’। ইসমাঈল (আ.) শুনে বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’। ইবরাহীম (আ.) তখন বললেন, ‘আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ’। আল্লাহর এই বড়ত্ব ঘোষণার এই দুআ আল্লাহর দরবারে এমন পছন্দ হল, পরবর্তীতে হজ্জ ও অন্য বিশেষ সময়ে এটা পাঠ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ওয়াজিব হিসেবে বিধান হয়ে গেল।13 তাকবীর পাঠ করে ইবরাহীম (আ.) যতোই চেষ্টা করেন ইসমাঈল (আ.) এর গলা কাটতে কিন্তু সক্ষম হন না। সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে থাকেন। আল্লাহ ইবরাহীম (আ.) এর এ কর্মকাণ্ড পছন্দ করেন। ইসমাঈল (আ.)কে যবেহ ব্যতিরেকেই এই কুরবানী কবূল করে নিলেন। আল্লাহ জান্নাতের দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন ইসমাঈল (আ.) এর জায়গায়। ইবরাহীম (আ.) দেখেন তার পুত্র নয় বরং একটি উন্নত দুম্বা জবাই হয়ে গেছে। হযরত আদম (আ.) এর পুত্র হাবিল যে দুম্বা কুরবানী করেছিলেন সেই দুম্বাই ইসমাঈল (আ.) এর স্থলে আল্লাহ পাঠিয়ে দেন।14 আল্লাহ পাকের দরবারে এ কুরবানী এতোই মাকবূল হয়েছিলো যে, এ কুরবানীর বিধান পরবর্তী সকল উম্মতের মধ্যে কিয়ামত পর্যন্ত প্রচলন করে দিলেন। আল্লাহ বলেন,
وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ
-আর আমি পরবর্তী উম্মতের মধ্যে ইবরাহীমের এ সুন্নাতকে স্মরণীয় করে রাখলাম। (সূরা সাফফাত, আয়াত-১০২)
আল্লাহ ইবরাহীম (আ.)কে অগ্নিকুণ্ডে পতিত হওয়াসহ অসংখ্য কঠিন ও কষ্টকর পরীক্ষায় ফেলেছিলেন। সবগুলোই ধৈর্য ও আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থাবলে উত্তীর্ণ হন। ইবরাহীম (আ.) এর জীবনে সর্বাধিক কঠিন এক পরীক্ষা ছিলো বৃদ্ধ বয়সে লাভ করা নিজের পুত্র ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানী করা। সেক্ষেত্রেও তিনি সফল হয়েছিলেন। বরং আল্লাহ এই ত্যাগের মোহনায় সকল জাতিকে আচ্ছাদিত করে দিলেন। পরবর্তী সবাইকে ইবরাহীম (আ.)কে স্মরণের নেযাম করে দিলেন। এমনকি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকেও কুরবানীর বিধানে আবদ্ধ করলেন। আল্লাহ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে বলেন,
فَصَلَّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
-আপনার রবের জন্য নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন। (সূরা কাউসার, আয়াত-২)
আরো ইরশাদ করলেন,
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
-বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছুই জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। (সূরা আনআম, আয়াত-১৬২)
এজন্য নবীজি eও কুরবানী দিতেন। সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিতেন কুরবানী করার। উম্মতের জন্যেও কুরবানীর বিধান রেখে দিয়েছেন।
ইবরাহীম (আ.) যেভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর সর্বাধিক প্রিয় বস্তু তথা তাঁর আপন পুত্রকে কুরবানী দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তেমনি মুসলমানরা ঈদুল আদহার দিনে নিজের পছন্দের পশু কুরবানীর মাধ্যমে নিজেদের জান-মাল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার নমুনা প্রকাশ করে থাকেন। এ কুরবানী একটি উদাহরণ। মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তার পছন্দসই সুন্দর পশু ক্রয় করে। অথচ এটিকেই আল্লাহর নামে জবাই করে দেয় কুরবানী হিসবে। নিজে কিছুটা ভক্ষণ করে। বাকিটুকু মানুষকে ভাগ করে দেয়। এই ত্যাগই কুরবানীর শিক্ষা। বান্দা যেকোন কিছু বিসর্জন দিতে পারে তার রবের আনুগত্য করতে। হোক তা তার প্রিয় বস্তু, প্রিয়জন কিংবা নিজের আপন জীবন। হতে পারে রবের সন্তুষ্টির জন্য নিজের জিনিস অন্যকে দান করে কিংবা কোনো কামনার বস্তুর লোভকে সংযত করার মাধ্যমে। মহীয়ান রবের সন্তুষ্টিলাভের জন্যে ত্যাগই হল কুরবানীর ইতিহাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মুসলমানরা এই ত্যাগই যুগে যুগে করে এসেছেন কুরবানীর প্রচলিত সুরতে।
সুত্র:
১. মুহাম্মদ ইবন আহমাদ কুরতুবী (৬৭১হি.), আল জামিউ লি আহকামীল কুরআনিল কারীম, (দারুল কুতুবিল মিসরিয়া, কায়রো, দ্বিতীয়প্রকাশ: ১৩৮৪ হি.) : ৬/১৩৪; আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (৮৫৫ হি.) উমদাতুল কারী ফী শারহিল বুখারী, (আল মাকতাবাতুশ শামেলা সংস্করণ) : ২৩/১৩৮
২. আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-حَتَّى يَأْتِيَنَا بِقُرْبَانِ تَأْكُلُهُ النَّارُ যতক্ষণ না সে এমন কুরবানী নিয়ে আসে, যাকে আগুন ভক্ষণ করে। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৮৩)
৩. আবূল ফিদাহ ইসমাঈল ইবন কাসীর, (৭৭৪ হি.), তাফসীরুল কুরআনিল আযীম (তাফসীরু ইবন কাসীর), দারু তায়্যিবা, বৈরুত, প্রকাশকাল: ১৪২০ হি.) : ৩/৮৩; ইসমাঈল ইবন মুস্তাফা আল ইস্তাম্বুলী (১১৩৭ হি.), তাফসীরু রুহিল বায়ান, দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবী : ১/৩০৪
৪. আবূ আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবন আব্দিল্লাহ আল হাকিম আন নিসাপুরী (৪০৫ হি.), আল মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, প্রকাশকাল: ১৪১১ হি. : ৩৪৬৭; মুসনানাদু আহমদ: ১৯২৮৩; সুনান ইবনি মাজাহ ৩১২৭
৫. সূরা হজ্জ-৭৮
৬. তাফসীরে ইবন কাসীর: ৭/২৭
৭. এ সময় ইসমাঈল (আ.) এর বয়স ছিলো সাত বছর। (জালালাইন ৮/৪০১), কোনো বর্ণনায় বয়স তেরো বছর। ইবন আব্বাস রাদ্বিইয়াল্লাহ আনহু বলেন, তখন তিনি বালিগ হন এবং নামায-রোযা আদায় করতেন। (তাফসীরে কুরতুবী: ১৫/৯৯)
৮. তাফসীরে কুরতুবী: ১৫/১০২
৯. কানযুল উম্মাল: ৩১৯৯০। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, নবীদের স্বপ্ন ওহী।-তিরমিযী: ৪০৫৩
১০. তাফসীরে ইবন কাসীর: ৭/২৮; মুসনাদু আহমাদ, আলামুল কুতুব, প্রথম প্রকাশ: ১৪১৯ হি. : ২৭০৭, মুহাম্মদ ইবন জারীর তাবারী, জামিউল বায়ান ফী তাবীলিল কুরআন, মুয়াসসাসাতুর রিসালা, প্রথম প্রকাশ: ১৪২০ হি. : ২১/৭৮। ইবরাহীম (আ.) এর এই আমলটি পরবর্তীতে হজ্জ পালনকারী মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব করে দেওয়া হয়।
১১. আল্লামা ইবন জারীর তাবারী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইসমাঈল (আ.) এর পরনে সাদা পোষাক ছিলো আর কাফনের কোনো পোষাক ছিলো না। তাই তিনি পিতাকে বললেন, বাবা আপনি আমার জামা খুলে রেখে দিন। তা দিয়ে আমার লাশের কাফন পরাতে পারবেন।-তাফসীরে তাবারী: ২১/৭৮, তাফসীরে ইবন কাসীর: ৭/২৮, তাফসীরে কাশশাফ: ৪/৫৫
১২. তাফসীরে তাবারী: ২১/৭৮, তাফসীরে ইবন কাসীর: ৭/২৮
১৩. তাফসীরে কুরতুবী: ১৫/১০২, তাফসীরে কাশশাফ : ৪/৫৫
১৪. তাফসীরে ইবন কাসীর: ৭/২৮
“এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন: তুমি যারা ঈমান এনেছো এবং যারা সৎকর্ম করেছো, তাদেরকে আমি অবশ্যই পরীক্ষায় ফেলাবো, যাতে আমি তাদেরকে তাদের প্রকৃত অবস্থায় পরীক্ষা করতে পারি। আর যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করবে, তার জন্য পুরস্কার হবে।”
(সূরা আল-বাকারা, ২:১৫৫)
Copyright © 2025 Imaduddin. All Rights Reserved. Developed by Redwan